স্টাফ রিপোর্টার:শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে তাঁকে প্রধান করার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাবে সম্মতি দেন তিনি।
বঙ্গভবন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সংকট উত্তরণে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা জরুরি। উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যান্য সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মনোনয়ন দেওয়ার পরামর্শ দেন। সংকট উত্তরণে দেশবাসীকে সহযোগিতা করারও আহ্বান জানান তিনি।
সমন্বয়কদের সূত্রে জানা যায়, ড. ইউনূসের পক্ষ থেকেও তাদের ৩১ সদস্যের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে বাকি উপদেষ্টাদের নাম চূড়ান্ত করা হবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাবনার জন্য। সূত্রের দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকার হবে ১৫ থেকে ২০ সদস্যের।
ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ তালিকায় নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আলী ইমাম মজুমদার, ড. শাহ্দীন মালিক, ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, মো. তৌহিদ হোসেন, শহীদুল্লাহ খান বাদল, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ। এর বাইরে বৈঠকে রাষ্ট্রপতি আরও একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ দু’জনকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আর একজন সংখ্যালঘু ও একজন আদিবাসী যুক্ত হতে পারেন।
সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই আলাপ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রস্তাব করেছেন তিন বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হবে। তবে এতে রাজি নয় বিএনপি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ছয় মাসের বেশি দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন বলে জানা গেছে।
বৈঠক শেষে রাতে ব্রিফিংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সময় ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। বর্তমান অরাজক পরিস্থিতিতে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা জরুরি। দেশবরেণ্য নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে এই সরকারের প্রাথমিক তালিকা আমরা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছি। ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানকারীর পক্ষ থেকে যে-ই সরকার প্রস্তাব করা হবে, সেটিই চূড়ান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে– সে নিশ্চয়তা আমরা বঙ্গভবন থেকে পেয়েছি। উপদেষ্টাদের প্রাথমিক তালিকায় নাগরিক সমাজসহ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তালিকা চূড়ান্ত করব।
এ সময় নাহিদের পাশে থাকা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় এখন তা প্রকাশ করা হবে না। আমরা একটা ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি সিচুয়েশনের’ মধ্যে এ সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এর সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার যে রীতি রয়েছে, তা অনুসরণ করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ এখনও ঠিক হয়নি। ড. ইউনূস দেশে আসার পর সার্বিক বিষয়ে ঘোষণা আসবে।
তিনি বলেন, বৈঠকে আমাদের সঙ্গে চার ছাত্র প্রতিনিধি অংশ নেন। রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানরা ছাত্রদের বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তাদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে। সত্যি বলতে, আমরা শুধু অভ্যুত্থানের নয়, আমাদের রাষ্ট্র গঠনের নেতাও পেয়ে গেছি।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ থেকে ১৫ সদস্যের তালিকা দেওয়া হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। আশা করছি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেশবাসী পেয়ে যাবে।
নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, ড. ইউনূসের মাইনর একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি প্যারিস থেকে বুধবার রওনা হবেন। ওই দিন রাত অথবা বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ঢাকা পৌঁছাবেন। এরই মধ্যে আমাদের তালিকাও চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, নুসরাত তাবাসসুম, আন্দোলনকারীদের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য মাহফুজ আলম, নাসির আবদুল্লাহ প্রমুখ।
এর আগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিনিবাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে পৌঁছায়। তবে বৈঠকে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আবদুল্লাহ অংশ নেন।
এর আগে গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। ছাত্রদের তরফ থেকেও অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করা হয়। ছাত্রদের এ প্রস্তাবে সম্মতিও দিয়েছেন তিনি। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও ড. ইউনূসের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন। বিএনপির তরফ থেকে দ্রুত নতুন সরকার গঠনের তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, অন্যথায় রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
ড. ইউনূস বর্তমানে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থান করছেন। চিকিৎসাজনিত কারণে তাঁর দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে। আজ বুধবার তিনি ঢাকায় পৌঁছাতে পারেন বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদও বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্যারিস থেকে ড. ইউনূস শিগগিরই ঢাকা ফিরছেন। যদিও বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার সময় বা দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি জানান, আজ বুধবার শপথ হবে– এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।
নতুন সরকারে যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিবিসিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যে শিক্ষার্থীরা এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তারা যখন এই কঠিন সময়ে আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন, তাহলে আমি কীভাবে তা প্রত্যাখ্যান করি?’