০৬:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, কোম্পানি বন্ধ, তবুও লেনদেন হচ্ছে ৩২ কোম্পানির শেয়ার

  • Md Mizanur Rahman
  • সময়ঃ ০৬:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
  • ০ সময়

বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম নেই। ডিএসই (ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ) তদারক করছে না। তবু ৩২টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। ডিএসইর তদারক ছাড়াই ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) এই লেনদেন হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজার থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছে তিনটি কোম্পানি। আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি পুঁজিবাজার ছাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে অপেক্ষা করছে।

এমন নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জিডিপিতে পুঁজিবাজার বড় ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের বেলায় তা ভিন্ন। একদিকে যেমন ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে না পারার কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, অন্যদিকে এমন সব কোম্পানিকে বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ দেয়া হয়েছে, যেগুলো আর্থিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল এমনকি অনেকের কোনো অস্তিত্বই নেই।

সূত্র বলছে, পুঁজিবাজার থেকে শুধু টাকা তোলার জন্য ব্যবসা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোসহ বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বেশিরভাগ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। অনেক কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয় না, শেয়ারে কারসাজি করে দাম বাড়ায় অনেকে। ফলে একটা সময় তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। এরপর কোম্পানিগুলোর খারাপ অবস্থার কারণে ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) স্থানান্তর করে পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৩২টি কোম্পানি পরিদর্শনে গিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ পেয়েছে।

বন্ধ ৩২ কোম্পানি: আলফা টোব্যাকো মেনুফ্যাকচারিং, আমাম সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, আশরাফ টেক্সটাইল মিলস, বাংলা প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ ডাইয়িং অ্যান্ড ফিনিশিং, বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিসিটি মিটার কোং, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোং, বাংলাদেশ লাগেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ জিপার ইন্ডাস্ট্রিজ, সিক টেক্স লিমিটেড, ড্যান্ডি ডাইয়িং, ডাইনামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, ইগল স্টার টেক্সটাইল মিলস, জার্মান বাংলা জেভি ফুড, গালফ ফুডস, লেক্সকো লিমিটেড, এম হোসাইন গার্মেন্টস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইয়িং, মেঘনা শ্রিম্প কালচার, মেটালেক্স করপোরেশন, মিতা টেক্সটাইল, মডার্ন সিমেন্ট, পেট্রো সিনথেটিক প্রোডাক্টস, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনাল, কাশেম টেক্সটাইল, রাস্পিত ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস, রাস্পিত ইনক বিডি, রোজ হ্যাভেন বল পেন, সালেহ কার্পেট মিলস, শ্রীপুর টেক্সটাইল, থেরাপিওটিক্স বাংলাদেশ এবং টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস।

এ ছাড়া আরও তিনটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে যশোর সিমেন্ট কোম্পানি, আরবি টেক্সটাইল এবং বাংলাদেশ প্ল্যানটেশন লিমিটেড।

তথ্য বলছে, এই কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও তাদের শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। যেসব বিনিয়োগকারীর কাছে এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার রয়েছে তারা এগুলো লেনদেন করছে। কোম্পানিগুলো ওটিসি মার্কেটে থাকায় এগুলো নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই কারও। এ ছাড়া শেয়ারের দর বৃদ্ধি বা কমা নিয়েও নেই কোনো আইনি বাধা। তাই নিজেদের খেয়াল খুশিমতো দাম কমিয়ে বাড়িয়ে লেনদেন করতে পারছেন এসব বন্ধ কোম্পানির শেয়ারধারীরা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করাসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে; কিন্তু যখন কোনো কোম্পানি ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দিকে বেশি মনযোগী হয়ে পড়ে, তখন ব্যবসার দূরবস্থা তৈরি হয়।

এসব কোম্পানির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসার আগে তাদের সম্পদ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে। পরবর্তীতে তারা ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা না করে তাদের ব্যক্তিগত পকেট ভারী করতে থাকে। নতুন অবস্থায় সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েকবছর যাওয়ার পর দেখা যায় সেই কোম্পানিগুলো আর টিকতে পারে না। ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা সংকুচিত হতে থাকে। ব্যাংক থেকে যে লোন নেয় কাও পরিশোধ করতে পারে না। এ সময় ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বন্ধ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করা আর জেনে-বুঝে বিষপান করা একই কথা; কিন্তু আমাদের বাজারে এমনটাই হতে দেখা যায়। এসব কোম্পানির মালিকদেরও তেমন মাথাব্যথা নেই। সবাই ওপেনলি জুয়া খেলছে।

৩২ বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দাম: গত বৃহস্পতিবার আলফা টোব্যাকোর শেয়ার ২১ টাকায় লেনদেন হতে দেখা যায়। এ ছাড়া আমাম সি ফুডের ২১৯ টাকা, আশরাফ টেক্সটাইল মিলসের ১৬ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলা প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজের ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ১৬ টাকা, বাংলাদেশ ডাইয়িং অ্যান্ড ফিনিশিংয়ের ২৩ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিসিটি মিটার কোংয়ের ৬১ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোংয়ের ২৪ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ লাগেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ১৪ টাকা, বাংলাদেশ জিপার ইন্ডাস্ট্রিজের ১৬ টাকা ৫০ পয়সা, সিক টেক্স লিমিটেডের ২ টাকা ৭০ পয়সা, ড্যান্ডি ডাইয়িংয়ের ৫ টাকা ৮০ পয়সা, ডাইনামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের ৪২ টাকা, ইগল স্টার টেক্সটাইল মিলসের ৯ টাকা ৯০ পয়সা, জার্মান বাংলা জেভি ফুডের ৩ টাকা ৬০ পয়সা, গালফ ফুডসের ১০ টাকা ৫০ পয়সা, লেক্সকো লিমিটেডের ২০ টাকা, এম হোসাইন গার্মেন্টস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইয়িংয়ের ২৩ টাকা, মেঘনা শ্রিম্প কালচারের ১৩২ টাকা, মেটালেক্স করপোরেশনের ১২৯ টাকা ৫০ পয়সা, মিতা টেক্সটাইলের ৬০ টাকা, মডার্ন সিমেন্টের ১ টাকা ৪০ পয়সা, পেট্রো সিনথেটিক প্রোডাক্টসের ৭ টাকা, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনালের ১১১ টাকা ৩০ পয়সা, কাশেম টেক্সটাইলের ৮ টাকা ১০ পয়সা, রাস্পিত ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনসের ৩ টাকা ৫০ পয়সা, রাস্পিত ইনক বিডির ১ টাকা ৯০ পয়সা, রোজ হ্যাভেন বল পেনের ১০ টাকা, সালেহ কার্পেট মিলসের ১০ টাকা ১০ পয়সা, শ্রীপুর টেক্সটাইলের ৯ টাকা ৫০ পয়সা, থেরাপিওটিক্স বাংলাদেশের ৩৬৯ টাকা ২৫ পয়সা এবং টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের শেয়ারদর ২৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজার থেকে বের হওয়ার উপায়: যে তিনটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে এক্সিট নিয়েছে এর মধ্যে যশোর সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ৩ হাজার ২৬৬ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার সংখ্যা ২৪ লাখ। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ৫৫ টাকা হিসাবে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার ত্যাগ করায় শেয়ারহোল্ডারদের এ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আরবি টেক্সটাইলসের শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ২০ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার ১৪ হাজার ২০টি। প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার ২০০ টাকা। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার ত্যাগ করায় শেয়ারহোল্ডারদের এ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ প্ল্যানটেশন লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ১২২ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার ৮১ হাজার ৭৭০টি। প্রতিটি শেয়ার ২৪০ টাকা দরে ১ কোটি ৯৬ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা তাদের দেনা রয়েছে কোম্পানিটি। যেহেতু কোম্পানিটি আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকছে না, সেহেতু এ পরিমাণ অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের পরিশোধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘একটি কোম্পানি যদি নিজে থেকে অবসায়নে যেতে চায়, তাহলে তাকে সব নিয়ম মেনে যেতে হবে। ওটিসিতে থাকা যেসব বন্ধ কোম্পানি রয়েছে এগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা যদি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নিয়ে অবসায়ন করতে চান, তাহলে তা সম্ভব হবে।’

বন্ধ কোম্পানিসহ ওটিসি মার্কেটে থাকা কোম্পানিগুলো নিয়ে টাস্কফোর্স কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টাস্কফোর্স তিন ধাপে কাজ করছে। দীর্ঘমেয়াদে বাজারের উন্নয়নের জন্য এসব বিষয় নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবস্থান: পুঁজিবাজারের বন্ধ কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, ‘ওটিসিতে যেসব কোম্পানি রয়েছে সেগুলো ইতোমধ্যে তালিকাচ্যুত হয়েই সেখানে গেছে। ওটিসির আদলে অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠন করা হয়েছে। একটা সময় হয়ত ওটিসি থাকবে না। এটিবি যদি পুরোপুরিভাবে কার্যক্রম শুরু করে তাহলে নিয়ম মেনে ওটিসি থেকে কিছু কোম্পানি কোয়ালিফায়েড অফারের মাধ্যমে এসএমইতে যেতে পারে। যেসব কোম্পানি নিয়ম মানতে পারবে না সেগুলো এটিবিতে যাবে।’

কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে বিএসইসি চাইলেবের করে দিতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিশনের এক্সিট প্ল্যান অনুযায়ী যদি তারা নিজে থেকে এক্সিট নিতে চায় তাহলে তাদের সে সুযোগ রয়েছে; কিন্তু কমিশন যেহেতু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে থাকে, সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালককে জোর করে শেয়ার কেনানোর নিয়ম নেই। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি কোম্পানি আইন মেনে ইজিএমে এমন সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাদের সার্বিক সহযোগিতা কমিশন করবে। কমিশন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে।’ এ ব্যাপারে ডিএসইর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।সূত্রঃ কালবেলা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Md Mizanur Rahman

জনপ্রিয় নিউজ

বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, কোম্পানি বন্ধ, তবুও লেনদেন হচ্ছে ৩২ কোম্পানির শেয়ার

বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, কোম্পানি বন্ধ, তবুও লেনদেন হচ্ছে ৩২ কোম্পানির শেয়ার

সময়ঃ ০৬:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম নেই। ডিএসই (ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ) তদারক করছে না। তবু ৩২টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। ডিএসইর তদারক ছাড়াই ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) এই লেনদেন হচ্ছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজার থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছে তিনটি কোম্পানি। আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি পুঁজিবাজার ছাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে অপেক্ষা করছে।

এমন নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর জিডিপিতে পুঁজিবাজার বড় ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের বেলায় তা ভিন্ন। একদিকে যেমন ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে না পারার কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, অন্যদিকে এমন সব কোম্পানিকে বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ দেয়া হয়েছে, যেগুলো আর্থিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল এমনকি অনেকের কোনো অস্তিত্বই নেই।

সূত্র বলছে, পুঁজিবাজার থেকে শুধু টাকা তোলার জন্য ব্যবসা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোসহ বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বেশিরভাগ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। অনেক কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয় না, শেয়ারে কারসাজি করে দাম বাড়ায় অনেকে। ফলে একটা সময় তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। এরপর কোম্পানিগুলোর খারাপ অবস্থার কারণে ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) স্থানান্তর করে পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৩২টি কোম্পানি পরিদর্শনে গিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ পেয়েছে।

বন্ধ ৩২ কোম্পানি: আলফা টোব্যাকো মেনুফ্যাকচারিং, আমাম সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, আশরাফ টেক্সটাইল মিলস, বাংলা প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ ডাইয়িং অ্যান্ড ফিনিশিং, বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিসিটি মিটার কোং, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোং, বাংলাদেশ লাগেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ জিপার ইন্ডাস্ট্রিজ, সিক টেক্স লিমিটেড, ড্যান্ডি ডাইয়িং, ডাইনামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, ইগল স্টার টেক্সটাইল মিলস, জার্মান বাংলা জেভি ফুড, গালফ ফুডস, লেক্সকো লিমিটেড, এম হোসাইন গার্মেন্টস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইয়িং, মেঘনা শ্রিম্প কালচার, মেটালেক্স করপোরেশন, মিতা টেক্সটাইল, মডার্ন সিমেন্ট, পেট্রো সিনথেটিক প্রোডাক্টস, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনাল, কাশেম টেক্সটাইল, রাস্পিত ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস, রাস্পিত ইনক বিডি, রোজ হ্যাভেন বল পেন, সালেহ কার্পেট মিলস, শ্রীপুর টেক্সটাইল, থেরাপিওটিক্স বাংলাদেশ এবং টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস।

এ ছাড়া আরও তিনটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে যশোর সিমেন্ট কোম্পানি, আরবি টেক্সটাইল এবং বাংলাদেশ প্ল্যানটেশন লিমিটেড।

তথ্য বলছে, এই কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও তাদের শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। যেসব বিনিয়োগকারীর কাছে এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার রয়েছে তারা এগুলো লেনদেন করছে। কোম্পানিগুলো ওটিসি মার্কেটে থাকায় এগুলো নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই কারও। এ ছাড়া শেয়ারের দর বৃদ্ধি বা কমা নিয়েও নেই কোনো আইনি বাধা। তাই নিজেদের খেয়াল খুশিমতো দাম কমিয়ে বাড়িয়ে লেনদেন করতে পারছেন এসব বন্ধ কোম্পানির শেয়ারধারীরা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করাসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে; কিন্তু যখন কোনো কোম্পানি ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের দিকে বেশি মনযোগী হয়ে পড়ে, তখন ব্যবসার দূরবস্থা তৈরি হয়।

এসব কোম্পানির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসার আগে তাদের সম্পদ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে। পরবর্তীতে তারা ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা না করে তাদের ব্যক্তিগত পকেট ভারী করতে থাকে। নতুন অবস্থায় সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েকবছর যাওয়ার পর দেখা যায় সেই কোম্পানিগুলো আর টিকতে পারে না। ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা সংকুচিত হতে থাকে। ব্যাংক থেকে যে লোন নেয় কাও পরিশোধ করতে পারে না। এ সময় ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বন্ধ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করা আর জেনে-বুঝে বিষপান করা একই কথা; কিন্তু আমাদের বাজারে এমনটাই হতে দেখা যায়। এসব কোম্পানির মালিকদেরও তেমন মাথাব্যথা নেই। সবাই ওপেনলি জুয়া খেলছে।

৩২ বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দাম: গত বৃহস্পতিবার আলফা টোব্যাকোর শেয়ার ২১ টাকায় লেনদেন হতে দেখা যায়। এ ছাড়া আমাম সি ফুডের ২১৯ টাকা, আশরাফ টেক্সটাইল মিলসের ১৬ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলা প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজের ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ১৬ টাকা, বাংলাদেশ ডাইয়িং অ্যান্ড ফিনিশিংয়ের ২৩ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিসিটি মিটার কোংয়ের ৬১ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোংয়ের ২৪ টাকা ৫০ পয়সা, বাংলাদেশ লাগেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ১৪ টাকা, বাংলাদেশ জিপার ইন্ডাস্ট্রিজের ১৬ টাকা ৫০ পয়সা, সিক টেক্স লিমিটেডের ২ টাকা ৭০ পয়সা, ড্যান্ডি ডাইয়িংয়ের ৫ টাকা ৮০ পয়সা, ডাইনামিক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের ৪২ টাকা, ইগল স্টার টেক্সটাইল মিলসের ৯ টাকা ৯০ পয়সা, জার্মান বাংলা জেভি ফুডের ৩ টাকা ৬০ পয়সা, গালফ ফুডসের ১০ টাকা ৫০ পয়সা, লেক্সকো লিমিটেডের ২০ টাকা, এম হোসাইন গার্মেন্টস ওয়াশিং অ্যান্ড ডাইয়িংয়ের ২৩ টাকা, মেঘনা শ্রিম্প কালচারের ১৩২ টাকা, মেটালেক্স করপোরেশনের ১২৯ টাকা ৫০ পয়সা, মিতা টেক্সটাইলের ৬০ টাকা, মডার্ন সিমেন্টের ১ টাকা ৪০ পয়সা, পেট্রো সিনথেটিক প্রোডাক্টসের ৭ টাকা, ফার্মাকো ইন্টারন্যাশনালের ১১১ টাকা ৩০ পয়সা, কাশেম টেক্সটাইলের ৮ টাকা ১০ পয়সা, রাস্পিত ডেটা ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনসের ৩ টাকা ৫০ পয়সা, রাস্পিত ইনক বিডির ১ টাকা ৯০ পয়সা, রোজ হ্যাভেন বল পেনের ১০ টাকা, সালেহ কার্পেট মিলসের ১০ টাকা ১০ পয়সা, শ্রীপুর টেক্সটাইলের ৯ টাকা ৫০ পয়সা, থেরাপিওটিক্স বাংলাদেশের ৩৬৯ টাকা ২৫ পয়সা এবং টিউলিপ ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের শেয়ারদর ২৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

পুঁজিবাজার থেকে বের হওয়ার উপায়: যে তিনটি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে এক্সিট নিয়েছে এর মধ্যে যশোর সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ৩ হাজার ২৬৬ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার সংখ্যা ২৪ লাখ। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ৫৫ টাকা হিসাবে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার ত্যাগ করায় শেয়ারহোল্ডারদের এ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আরবি টেক্সটাইলসের শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ২০ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার ১৪ হাজার ২০টি। প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার ২০০ টাকা। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার ত্যাগ করায় শেয়ারহোল্ডারদের এ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ প্ল্যানটেশন লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার রয়েছেন ১২২ জন। তাদের সমন্বিত শেয়ার ৮১ হাজার ৭৭০টি। প্রতিটি শেয়ার ২৪০ টাকা দরে ১ কোটি ৯৬ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ টাকা তাদের দেনা রয়েছে কোম্পানিটি। যেহেতু কোম্পানিটি আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকছে না, সেহেতু এ পরিমাণ অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের পরিশোধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘একটি কোম্পানি যদি নিজে থেকে অবসায়নে যেতে চায়, তাহলে তাকে সব নিয়ম মেনে যেতে হবে। ওটিসিতে থাকা যেসব বন্ধ কোম্পানি রয়েছে এগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা যদি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নিয়ে অবসায়ন করতে চান, তাহলে তা সম্ভব হবে।’

বন্ধ কোম্পানিসহ ওটিসি মার্কেটে থাকা কোম্পানিগুলো নিয়ে টাস্কফোর্স কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টাস্কফোর্স তিন ধাপে কাজ করছে। দীর্ঘমেয়াদে বাজারের উন্নয়নের জন্য এসব বিষয় নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবস্থান: পুঁজিবাজারের বন্ধ কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, ‘ওটিসিতে যেসব কোম্পানি রয়েছে সেগুলো ইতোমধ্যে তালিকাচ্যুত হয়েই সেখানে গেছে। ওটিসির আদলে অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠন করা হয়েছে। একটা সময় হয়ত ওটিসি থাকবে না। এটিবি যদি পুরোপুরিভাবে কার্যক্রম শুরু করে তাহলে নিয়ম মেনে ওটিসি থেকে কিছু কোম্পানি কোয়ালিফায়েড অফারের মাধ্যমে এসএমইতে যেতে পারে। যেসব কোম্পানি নিয়ম মানতে পারবে না সেগুলো এটিবিতে যাবে।’

কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে বিএসইসি চাইলেবের করে দিতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিশনের এক্সিট প্ল্যান অনুযায়ী যদি তারা নিজে থেকে এক্সিট নিতে চায় তাহলে তাদের সে সুযোগ রয়েছে; কিন্তু কমিশন যেহেতু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে থাকে, সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালককে জোর করে শেয়ার কেনানোর নিয়ম নেই। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি কোম্পানি আইন মেনে ইজিএমে এমন সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাদের সার্বিক সহযোগিতা কমিশন করবে। কমিশন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে।’ এ ব্যাপারে ডিএসইর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।সূত্রঃ কালবেলা