আজকের ঢাকা প্রতিনিধি : আরবি পঞ্জিকার সর্বশেষ মাস হলো জিলহজ্জ মাস। ইসলামে যে চার মাসকে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বলা হয়েছে, এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস এটি। আর এ মাসের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সময় হলো ‘আশারায়ে জিলহজ’ তথা জিলহজ মাসের প্রথম দশক। জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।হাদিসের বর্ণনায় এ মাসের প্রথম ১০ দিনের রয়েছে বিশেষ আমল ও ফজিলত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে কী বলেছেন?
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের তিন দেশ
কুরআনে জিলহজ মাসের মর্যাদা
১. আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের সুরা ফাজরে জিলহজের প্রথম ১০ রাতের শপথ করে এ দিনগুলোর মর্যাদা তুলেছেন। প্রথম দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ ভোরবেলার! শপথ ১০ রাতের!’ তাফসিরে ইবনে কাসিরেও এ ১০ রাতের শপথ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১০ রাতের শপথ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনই উদ্দেশ্য।
২. আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর স্মরণ করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ২৮) মুফাসসির সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘(এ নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য) জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন।’
জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত
১. জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের ফজিলত জিহাদের চেয়েও মর্যাদাবান। হাদিসে এসেছে- হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) আমলের তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোনো সময় উত্তম নয় । তারা বলল : জিহাদও না ? তিনি বললেন : জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি।’ ( বুখারি)
জিলহজ মাসটি মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ হওয়ার অন্যতম দুটি। প্রথমটি হলো-এ মাসেই হজ তথা ইয়াওমে আরাফাহ অনুষ্ঠিত হয়। হাদিসে পাকে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়াকেই হজ বলা হয়েছে। তাছাড়া কেউ যদি ৯ জিলহজ (আরাফার দিন) সন্ধ্যার আগে মুহূর্তের জন্য হলেও আরাফার ময়দানে উপস্থিত না হয় তবে তার হজ হবে না। পরবর্তী বছর আবার তাকে হজ আদায় করতে হবে।
দ্বিতীয়টি হলো- কুরবানি। যা ইসলামের অন্যতম নির্দশন ও সুন্নাত। ফজিলতপূর্ণ এ দুইটি কাজ মর্যাদাপূর্ণ মাস রমজানেও আদায় করা সম্ভব নয়।
জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল
১. বুখারি, নাসাঈ, মুসলিম ও মিশকাতের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন কুরবানি করার আগ পর্যন্ত রোজা পালনসহ যে কোনো নেকির কাজ অধিক সাওয়াব ও ফজিলতপূর্ণ। সে হিসাব ১ থেকে ৯ জিলহজ পর্যন্ত রোজা রাখা যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ দিনগুলোতে রোজা রাখতেন।’
২. ৯ জিলহজ আরাফার দিনের রোজা রাখা বিশেষ মর্যাদার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আরাফার দিনের রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার এক বছর আগের এবং এক বছর পরের সব ছোট গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম, মিশকাত)
৩. কোনো ওজর আপত্তি না দেখিয়ে আর্থিক ও শারীরিক সক্ষম ব্যক্তিদের হজ আদায় করা।
৪. যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব, তাদের কুরবানি আদায় করা। আর যাদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম আত্মত্যাগের নিদর্শন কুরবানি আদায় করা। কারণ সম্পদহীন ব্যক্তি কুরবানির আগ্রহ প্রদানে আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে স্বচ্ছলতা দান করতে পারেন।
৫. জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানি সম্পাদনের আগে পর্যন্ত নখ, চুল ও মোচ ইত্যাদি না কাটা। হাদিস এসেছে-
হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাবে, এবং তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন চুল নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। (মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
৬. জিলহজ মাসের পাঁচ দিন তাকবিরে তাশরিক আদায় করা আদায় করা। তাকবিরে তাশরিক হলো-
‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
আর তা ৯ জিলহজ ফজর নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে ১৩ জিলহজ আসার নামাজের সময় শেষ হবে। মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়তে হয়। চাই নামাজ জামাআতে কিংবা একাকি পড়া হোক।
আর তাকবিরে তাশরিক পুরুষরা উচ্চ স্বরে আর মহিলার স্বশব্দে নিচু স্বরে পড়বে। অর্থাৎ মহিলাদের তাকবিরের শব্দ যেন (গাইরে মাহরাম) অন্য লোকে না শোনে।
৭. শুধু ঈদের দিন (১০ জিলহজ) ব্যতিত জিলহজের প্রথম দশকে রোজা রাখা অনেক ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (ঈদের দিন ব্যতিত) জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা পালন করতেন।
এ মাসের নবম দিন ও রাত আল্লাহর নিকট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দিনটি হলো আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন। আর রাতটি হলো মুজদালিফায় (শবে কদরের মতো গুরুত্বপূর্ণ) অবস্থানের রাত।
৮. বিশেষ করে ৯ জিলহজ রোজা আদায়ের ব্যাপারে প্রিয়নবি সবচেয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন যে, এ দিনের রোজা পালনকারীর বিগত এক বছর এবং আগাম (সামনের) এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।
আরাফাতের দিন অর্থাৎ ৯ জিলহজ নফল রোজা রাখা বিশেষ সুন্নত। তবে আরাফাতে অবস্থানরত হাজি সাহেবদের জন্য এই রোজা প্রযোজ্য নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তাআলা তার (রোজাদারের) বিগত এক বছরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৭)
আইয়ামে তাশরিক তথা জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষগণ স্বাভাবিক স্বরে, আর নারীগণ নিম্ন স্বরে তাকবির বলবেন। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ (ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮)
জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যেকোনো দিন, কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী—সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য। (ইবনে মাজাহ: ২২৬)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, জিলহজ মাসের বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা পাওয়ার জন্য নির্ধারিত আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের নির্ধারিত আমলগুলো পালনের মাধ্যম হাদিসে ঘোষিত ফজিলত ও মর্যাদাগুলো পাওয়ার তাওফিক দান করুন।